Wednesday, May 20, 2009

ভাইয়ের হাতে ভাই খুন

রাজধানীতে ভাইয়ের গুলিতে নিহত হয়েছেন ভাই। জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ও ব্যবসায়ী করিম উদ্দিন ভরসার ছেলে খায়রম্নল ইসলাম ভরসা ওরফে কাজল (৩০) গতকাল নিহত হয়েছেন নিজেরই বড় ভাইয়ের গুলিতে। ৪০, বিজয়নগরের সাততলার 'নিউ এইচ টোবাকো'র কার্যালয়ে গত ২৭ এপ্রিল বিকাল তিনটায় তাকে গুলি করে হত্যা করে বড় ভাই কবিরুল ইসলাম। হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঘাতক বড় ভাই কবিরম্নল ইসলাম ভরসা পালিয়ে যান। রংপুরের বহুল আলোচিত দুই ভাই করিম উদ্দিন ভরসা ও রহিম উদ্দিন ভরসার মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক থাকলেও ২৭ এপ্রিল তাদেরই একজনের সনত্দান রাজধানীর বুকে খুন হলেন সহোদরের গুলিতে। ভরসা পরিবারের সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে বিরোধের জের ধরেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে। নিহত কাজলের মায়ের নাম সুলতানা রাজিয়া। তিনি করিম উদ্দিন ভরসার দ্বিতীয় স্ত্রী। করিম উদ্দিন ভরসার দ্বিতীয় স্ত্রী সুলতানা রাজিয়ার চার ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে নিহত কাজল চতুর্থ। তার স্ত্রী শারমিন এবং ওয়াসেকুল ইসলাম ভরসা নামে দেড় বছরের এক শিশু সন্তান রয়েছে। রাজধানীর বনানীর আই বলকের এক নম্বর রোডের ১৩ নম্বর বাড়ির চতুর্থ তলায় থাকতেন কাজল। একই বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতেন তার ঘাতক বড় ভাই কবিরুল ইসলাম ভরসা। নিহতের শ্যালক ইমরান হাসান জানান, বিকাল তিনটার দিকে কাজলের বড় ভাই কবিরুল ইসলাম ভরসা বিজয়নগরের ছোট ভাইয়ের অফিসে যান। কাজল এ টোবাকো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ভবনের সাততলায় ছোট ভাইয়ের এ অফিসে প্রায়ই যাতায়াত করতেন বড় ভাই কবিরুল। সেদিনও তিনি সেখানে গেলে কর্মচারীদের মনে কোন সন্দেহ হয়নি। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ পেয়ে অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজলের অফিস কক্ষের দিকে যেতে দেখেন, কবিরুল দ্রুত চলে যাচ্ছে। তারা অফিস কক্ষে ঢুকে দেখেন খায়রুল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চেয়ারে পড়ে আছেন। দ্রুত তাকে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ও পরে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। পরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কবিরম্নলকে ধরতে নিচে নামলেও ততক্ষণে কবিরুল নিচে রাখা প্রাইভেট কারে করে পালিয়ে যান। খবর পেয়ে পল্টন থানা পুলিশ বিকাল সাড়ে পাঁচটায় নিহতের লাশ স্কয়ার হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায়। পল্টন থানার এসআই সামছুর রহমান জানান, চারটি গুলি কাজলের বুকে, পিঠে ও বগলে বিদ্ধ হয়। পুলিশের ঊধর্্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। নিহতের শ্যালক ইমরান আরও জানান, কবিরুল ছোট ভাই কাজলের কাছ থেকে প্রায় প্রতিমাসেই হাত খরচার নামে টাকা নিতেন। কবিরুল মাদকাসক্ত বলেও তিনি জানান। নিহতের ভগি্নপতি মো. সোহেল জানান, দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসায়িক বিষয় নিয়ে পারিবারিক বিরোধ চলে আসছিল। এর জের ধরেও কাজলকে হত্যা করা হতে পারে বলে তার ধারণা।

স্ত্রী শারমিন বাকরুদ্ধ

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে খায়রুল ইসলামের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে নেয়া হলেও তার পিতা করিম উদ্দিন ভরসা সেখানে যাননি। খায়রুল গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই বাকরুদ্ধ তার স্ত্রী শারমিন আলী (২৮)। কারও সঙ্গে সঙ্গে কথা বলেন নি তিনি। কাজলের সঙ্গে সিলেটের হাজী ওসমান আলীর কন্যা শারমিন আলীর বিয়ে হয় প্রায় তিন বছর আগে। তাদের ১৮ মাসের ওয়াসেক নামের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে।

বাড়ি নম্বর আনলাকি থার্টিন!

১০ কাঠা জমির ওপর চারতলা বাড়ি। বাড়ি নম্বর ১৩। আশপাশের মানুষের কাছে এই প্রথম নম্বরটি চিহ্নিত হচ্ছে অপয়া হিসেবে। বড় ভাইয়ের হাতে ছোট ভাই খুন হওয়ার ঘটনার পর বাড়িটিতে নেমে এসেছে রাজ্যের অাঁধার। বহু বছর পর গত ২৭ এপ্রিল প্রথমবারের মতো সন্ধ্যায় আলো জ্বলেনি চারতলা বাড়ির কোন কামরায়। শুধু নিচতলার পার্কিং এলাকায় বাড়ির কেয়ারটেকার মঞ্জুর আলম জ্বালিয়েছেন একটি বাতি। এর আগে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে র্যাবের একটি দল বাড়ির সদস্যদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় র্যাব কবিরম্নলের স্ত্রীর বক্তব্য রেকর্ড করে। র্যাবের উপস্থিতি দেখে বনানীর বাড়িটিকে ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড় লেগে যায়।

এক বাড়িতে ২৬ জনের বসবাস

নিহত কাজলের বাবা করিমউদ্দিন ভরসার দুই স্ত্রী। বড় স্ত্রীর ছয় ছেলে তিন মেয়ে। ছোট স্ত্রীর ছেলে চার জন, মেয়ে দুই জন। বনানীর বাড়িটিতে থাকেন বড় স্ত্রীর দু' ছেলে সপরিবারে। আর ছোট স্ত্রীর তিন ছেলে সপরিবারে। সব মিলিয়ে বাড়িটিতে পাঁচ ছেলে ও তাদের স্ত্রী-সন্তানসহ থাকেন ২৬ জন।

সবার আদরের, সবার সেরা

নিহত কাজল ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শান্ত। কখনও কোন প্রয়োজনে মিথ্যে বলতেন না। উচ্চ শিক্ষার জন্য কানাডা ছিলেন বেশ ক'বছর। বছর তিনেক আগে দেশে ফিরে বিয়ে করেন। দু' বছরের সংসারে এক সন্তানের জনক হয়েছেন। বাড়ির কেয়ারটেকার মঞ্জুর আলম জানান, সাহেব ছিলেন ভাল মানুষ। কখনও মিথ্যা বলতেন না। সবার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলতেন। তিনি বলেন, ৩৪ বছর ধরে এ বাড়িতে কেয়ারটেকারের কাজ করি। কখনও ঝগড়া-কাইজা দেখিনি। টাকা-পয়সা নিয়ে রেষারেষিও দেখিনি।

কবিরুল ছিল নেশাসক্ত

কবিরম্নলের স্ত্রী র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, কবিরুল ছিল নেশাসক্ত। তবে ঘরের বাইরে কখনও নেশা করতো না। যা খাওয়ার ঘরে খেতো। সারাক্ষণ টেনশনে থাকতো। মেজাজ কিছুটা খিটখিটে ছিল। তবে সে খুনের মতো কোন ঘটনা ঘটাতে পারে_ এ ছিল চিন্তার বাইরে।

ভর্তা হলেও ভাগ করে খেতো

চারতলা বাড়িতে বসবাসকারী দু'পক্ষের পাঁচ ভাই ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে ছিল সদভাব। পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করতো চারটি গাড়ি। কে কখন কোন গাড়ি ব্যবহার করবে তা-ও নির্ধারিত ছিল না। তারপরও গাড়ি নিয়ে ছিল না মন কষাকষি। কেয়ারটেকার মঞ্জুর আলম জানান, সব ভাইয়ের সঙ্গে সবার এমন সম্পর্ক ছিল যে পাঁচজন সৎ ভাই_ তাও কেউ কখনও বুঝতো না। তিনি বলেন, ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে অন্য ভাইয়ের পরিবারের সম্পর্ক এমন ভাল ছিল যে_ কোন ঘরে বিশেষ ভর্তা হলেও তা ভাগ করে খেতো।

বাপ-চাচার সম্পর্কও সাপে-নেউলে

গতকাল ঢাকায় নিহত খাইরুল ইসলাম কাজলের পিতার ও চাচার সম্পর্কও সাপে-নেউলে। তার পিতা করিম ভরসা ও চাচা রহিম ভরসা দু'ভাই, দু'বেয়াই। স্থানীয় লোকজন জানান, বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা এটাই তাদের মূলমন্ত্র। রাজনৈতিক মতাদর্শেও তারা ভিন্ন। একে অপরের শত্রু প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯৯০ সালের পর থেকে রংপুরের একই আসন থেকে দুই ভাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বড় ভাই রহিমউদ্দিন ভরসা বিএনপি'র ও করিমউদ্দিন ভরসা জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সভাপতি। রাজনীতি, ব্যবসা, বাণিজ্য ও সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে বিরোধিতা চলছিল। এ কারণে একে অপরের ছায়া মাড়াতেও রাজি নন। বিভিন্ন সভা সমাবেশে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও কটূক্তি করতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেন না। একজন কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে পাশাপাশি অপরজনও একই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার উদাহরণ তৈরি করেন। করিমউদ্দিন ভরসার অভিযোগ রহিমউদ্দিন ভরসা তাকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছেন। অপরদিকে রহিমউদ্দিন ভরসার অভিযোগ সম্পত্তি দেয়া হয়েছে কিন্তু করিমউদ্দিন তা নষ্ট করেছে।

No comments:

Post a Comment