Monday, May 9, 2011

প্রেমের আগুনে পুড়ে হলো অঙ্গার


বিপাশার দীর্ঘদিনের প্রেম বিয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা পেলেও সুখ আসেনি জীবনে। প্রায় ৩ বছর ভালবাসার মানুষ দীপঙ্করের সংসার করেছে। কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে বধূবেশে দীপঙ্করের হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল সে স্বপ্ন অঙ্কুরেই নিঃশেষ হয়ে যায়। আর তাই মাঝে মাঝেই বিপাশা গুন গুন করে গেয়ে উঠতো- প্রেমের আগুনে পুড়ে হলাম অঙ্গার। মৃত্যুর সময়ও তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে সে গান। বাংলাবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী বিপাশা সরকার। তার পিতা স্বর্ণকার বিদ্যাধর সরকার। ২ ভাই ৩ বোনের মধ্যে বিপাশা সবার ছোট। সংসারে আদর সোহাগে বড় হয়েছে। ৯ নম্বর তাঁতীবাজারের বাসা থেকে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে একই এলাকার দীপঙ্কর ধর তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো। একদিন দু’দিন এভাবে মাস যায়। পরে দীপঙ্করের প্রেমের ফাঁদে ধরা দেয় বিপাশা। ২ বছরের প্রেমের পর দীপঙ্করের হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করে। পরে বিপাশার পরিবার তা মেনে নেয়। কিন্তু দীপঙ্করের মনে যে বিষ ছিল তা জানতো না। বিপাশা লাল শাড়ি পরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েই প্রেমিকের আসল রূপ ধরা পড়ে তার সামনে। যৌতুকের জন্য নানাভাবে নির্যাতন শুরু হয় তার ওপর। শেষ পর্যন্ত ভালবাসার মানুষের হাতেই প্রাণ দিতে হলো তাকে। আর এ মৃত্যু ৯নং তাঁতীবাজার লেনের বিদ্যাধর সরকারের বাসায় নিয়ে এসেছে শোকের মাতম।
বিপাশার বউদি প্রিয়াঙ্কা বলেন, শুক্রবার বিপাশা গিয়েছিল তার মোবাইল ফোন নিয়ে আসার জন্য তার স্বামীর বাসায়। সেখানেই বিপাশাকে নির্মমভাবে প্রহার করে দীপঙ্কর। প্রিয়াঙ্কা বলেন, তাকে মারতে পারে- এ ভয়ে বিপাশা আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যায়। বাসায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্কর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছে শিল-নোড়া, থালা-বাটি, মগ সব কিছু দিয়ে পিটিয়েছে। ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা বিপাশার পেটে একের পর লাথি মেরেছে। মাথায়ও মেরেছে। বিপাশাকে বাঁচাতে গেলে আমাকেও কিল ঘুষি লাথি মারে। এরপর কোন রকমে আমরা দু’জনে পালিয়ে আসি। আসার পর থেকেই বিপাশা আর বিছানা থেকে মাথা তুলতে পারেনি। বিপাশার মা সুচিত্রা সরকার বলেন, শনিবার সকালে সে বলেছিল, মা আমার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে। আমি বাঁচবো না। আমাকে মাফ করে দিও। এ কথা বলতে বলতে পায়খানা-বমি-প্রস্রাব করে। পরে তাকে আমরা ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে সে বিকাল আড়াইটার দিকে মারা যায়। মারা যাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে বিপাশার শাশুড়ি চিকিৎসা সংক্রান্ত সব কাগজপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। এরপর বিপাশার লাশ নিয়ে নানাভাবে টানাহেঁচড়া চলতে থাকে। এ সময় হাসপাতালে দীপঙ্কর তার লোকজন নিয়ে এসে বিপাশার ভাই বিজয় সরকার ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা চালায়। বিপাশার মা সুচিত্রা সরকার বলেন, আমার মেয়ে ২০০৯ সালে নবম শ্রেণীতে পড়তো বাংলাবাজার সরকারি হাইস্কুলে। একদিন স্কুল থেকে আসার সময় তাকে জোর করে তুলে নিয়ে বিয়ে করে মাদকাসক্ত দীপঙ্কর। গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদকে আসক্ত ছিল সে। মেয়ের ইচ্ছা ছিল এ ছেলেকে বিয়ে করার। এজন্য লোকলজ্জার ভয়ে আমরা আর কিছু বলিনি। ১৬ ভরি স্বর্ণ ও ২ লাখ টাকাসহ মেয়েটি তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে মেয়ের জীবনে শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। প্রিয়াঙ্কা বলেন, স্বামী আর শাশুড়ি তাকে প্রতিদিনই মারতো। এ কথা সে আমাদের কখনও বলতো না। আর টাকা চাইতো। আজ আমার কানের দুল, কাল আমার শাশুড়ির হাতের শাঁখা- এভাবে আমরা যখন যা পেরেছি বিপাশার হাতে তুলে দিয়েছি। এভাবে বিয়ের পরও তাকে ৪-৫ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার দিয়েছি। কিন্তু কিছুই রাখতে পারেনি। কারণ তার স্বামী ছিল হেরোইনসেবী। স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাস খানেক আগে আমাদের বাসায় চলে আসে। বাসায় আসার পর বৃহস্পতিবার দীপঙ্কর এ বাসায় আসে। এক ফাঁকে বিপাশার ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন আর ৫ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আর এ মোবাইল ফোন আনতে গিয়েই বিপাশার জীবনে নেমে আসে মৃত্যু।
গত শনিবার বিপাশা মারা যাওয়ার পর থেকে তার মৃতদেহ নিয়ে শুরু হয় হয়রানি। ডেথ সার্টিফিকেট দিতে ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুরু করে গড়িমসি। অন্যদিকে দফায় দফায় দীপঙ্কর ও তার বাহিনী বিপাশার বাবা ও ভাইয়ের ওপর হামলা চালাতে থাকে। কোতোয়ালি থানার পুলিশ চেষ্টা করেও বিপাশাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনতে পারেনি। এক দল পুলিশের ডিউটি শেষে বিপাশার লাশ নেয়ার জন্য হাসপাতালে আসে আরেক দল পুলিশ। আসে সূত্রাপুর থানার পুলিশও। তারা কেউ নিতে পারেনি মৃতের ডেথ সার্টিফিকেট। শেষ পর্যন্ত ন্যাশনাল হাসপাতাল থেকে মৃত বিপাশাকে ছাড়া হয় রাত ১২টায়। তবে কোন ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে কোতোয়ালি থানার এসআই ও বিপাশা হত্যা চেষ্টার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবু হায়দার মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, আমি এরকম ঘটনা আর কোনদিন দেখিনি। মারা যাওয়ার পর তার লাশ কেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ধরে রাখলো- তা আমি বুঝতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত লাশ ছাড়লেও তারা কোন ডেথ সার্টিফিকেট দেয়নি। ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই লাশ আমরা নিয়ে যাই। রাত ১২টায় দীপঙ্করকে আসামি করে বিপাশার পিতা বিদ্যাধর সরকার বাদী হয়ে মামলা (মামলা নম্বর ৭) করেন। এসআই আশরাফুজ্জামান বলেন, গতকাল সকালে নিহতের সুরতহাল রিপোর্টের পর তার লাশ পোস্টমর্টেম করা হয়। মৃত বিপাশার সারা শরীরে বিভিন্ন জখমের দাগ ছিল। পেটেও ছিল আঘাতের দাগ। মাথার পিছনে ছিল থেঁতলানো।

No comments:

Post a Comment