Saturday, October 31, 2009

স্মৃতি রহস্যের জট খুলছে না

পুরো নাম স্মৃতি মিতা সাইফ আফজাল। তবে স্মৃতি নামেই তাকে লোকজন চেনেন বেশি। সম্প্রতি মডেল হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু দেড় সপ্তাহ ধরে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রহস্যজনক এক গাড়ি দুর্ঘটনার পর থেকে স্মৃতি নিখোঁজ। ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া স্মৃতির সহযাত্রীরা বলছেন, স্মৃতি তাদের সঙ্গে গাড়িতেই ছিলেন। দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে। পুলিশও তেমনটিই ধারণা করছে। কিন্তু এতদিনেও স্মৃতির লাশ উদ্ধার না হওয়ায় ওই কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেকে। স্মৃতির বাবা-মায়ের দাবি, তাদের মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। গাড়ি দুর্ঘটনায় স্মৃতি নিহত হয়নি, তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে মৌলভীবাজারের স্মৃতি নিখোঁজের ঘটনা পুরোটাই এখন রহস্যে ঘেরা। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পান স্মৃতি। বাবা সাইফ আফজাল ও মা মলি আফজাল বলেন, 'স্মৃতি ভীষণ হাসিখুশি ও মিশুক মেয়ে। শোবিজের প্রতি আগে থেকেই তার অসম্ভব ঝোঁক। স্বপ্ন ছিল বড় মডেল হওয়ার। কিছুটা সাফল্যও পেয়েছিল। এরই মধ্যে সে একটি বিজ্ঞাপন চিত্রে মডেল হওয়ার সুযোগ পায়। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কোরিওগ্রাফি করত। মডেল হওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।' তারা বলেন, 'স্মৃতি সহজেই মানুষকে আপন করে নিত। আর সেটাই তার কাল হয়েছে। মানুষ সে সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে।'গত ১৬ অক্টোবর স্মৃতি আফজাল ও তার ভাই সিনহাকে নিয়ে একটি প্রাইভেটকারে করে সিলেট বেড়ানোর জন্য বের হয় তিন বন্ধু তারেক, সৈকত ও তানভীর। সিলেট থেকে মৌলভীবাজারে আসার পথে গত ১৮ অক্টোবর মৌলভীবাজার শহরতলির বালিকান্দি খেয়াঘাট এলাকায় মনু নদীতে ছিটকে পড়ে তাদের প্রাইভেটকার। রহস্যময় ওই দুর্ঘটনার পর সিনহা, ফরহাদ বিন তানভীর, সৈকত, শামীম মিয়া ও তারেককে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু স্মৃতি আফজালকে পাওয়া যায়নি। দমকলকর্মীরা বলছেন, তারা দুর্ঘটনাস্থলে আর কাউকে খুঁজে পাননি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, স্মৃতি কি জীবিত আছেন, নাকি মারা গেছেন। গাড়ি দুর্ঘটনায় যদি স্মৃতি নিহত হয়ে থাকেন, তাহলে তার লাশ গেল কোথায়? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাইফ আফজাল বলেন, 'স্মৃতিকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে। সে এখনও জীবিত। ওকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।' স্মৃতির মায়ের আহাজারি, 'এমন রহস্যের মধ্যে যেন কাউকে পড়তে না হয়।' পুলিশ অবশ্য বলছে, স্মৃতি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। মনু নদীতে গাড়ি ছিটকে পড়ার ঘটনাকে রহস্যজনক মনে করছে না পুলিশ। হয়তো নদীতে স্মৃতির লাশ ভেসে গেছে। কিন্তু স্মৃতির স্বজন, দমকলকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, স্মৃতি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। তাকে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে অথবা হত্যা করা হয়েছে। এমন অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ এবং সন্দেহের মধ্যে কেটে গেছে ১১ দিন। স্মৃতির কোনো হদিস মেলেনি। মডেল স্মৃতির পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশ ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। স্মৃতির মা গত বৃহস্পতিবার আবারও সমকালকে বলেন, 'আমার মেয়ে মারা যায়নি। ও এখনও বেঁচে আছে। তারেক, সৈকত ও তানভীরকে জিজ্ঞেস করলেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।' মৌলভীবাজার মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অমূল্য কুমার চৌধুরী আগে থেকেই বলে আসছেন স্মৃতি গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি আবারও বলেন, 'মডেল স্মৃতি গাড়ি দুর্ঘটনাতেই মারা গেছেন। লাশ উদ্ধার না হলেও তার প্রমাণ মিলেছে। কারণ দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িতে তার দুটি ব্যাগ পাওয়া গেছে।' ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন ওসি অমূল্য কুমার চৌধুরী। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, দুর্ঘটনার পরপরই সেখানে উপস্থিত হন মৌলভীবাজার মডেল থানার এসআই হারুন। তিনি স্মৃতির ব্যাপারে এখন কোনো মন্তব্য করছেন না। দুর্ঘটনাস্থলে স্থানীয় সাংবাদিকরা তারেক, সৈকত ও তানভীরের ছবি তুলতে গেলে এসআই হারুন তাতেও বাধা দেন। পুলিশ আর স্মৃতির লাশের সন্ধান করছে না। উদ্ধার তৎপরতা আনুষ্ঠানিক শেষ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মৌলভীবাজার দমকল বিভাগের সিনিয়র লিডার শামছুল আলম সমকালকে বলেন, 'পুরো বিষয়টি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। মেয়েটি আদৌ গাড়িতে ছিল কি-না সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। তাছাড়া পানিতে পড়ে মারা গেলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে লাশ ভেসে ওঠার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত লাশ পাওয়া যায়নি।' দুর্ঘটনার পর তানভীর, তারেক ও সৈকত পুলিশকে বলেন, তারা সবাই গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তাই কীভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে তা তারা বলতে পারছেন না। স্মৃতির মা জানান, সিনহা এখনও স্ব্বাভাবিক হয়নি। ঘটনার পর থেকে সে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। সে সঠিকভাবে কিছুই বলতে পারছে না। স্মৃতিকে অপহরণ করার জন্য ছোট্ট সিনহাকে কিছু খাইয়ে দিয়ে এমন বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। দুর্ঘটনার সময় বোন স্মৃতি গাড়িতে ছিল কি-না তা মনে করতে পারছে না সিনহা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্মৃতির সহযাত্রী তারেক, সৈকত ও তানভীরের বাসা ঢাকায়। তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারেক ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে বিকম পাস করেছেন। সৈকত এসএসসি পাস করে গুলশানে বাবার ব্যবসা দেখেন। আর তানভীর রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিন বন্ধুর মধ্যে তারেকের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে স্মৃতির প্রথম পরিচয় হয়। এরপর তানভীর ও সৈকতের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। তানভীর ওই সূত্র ধরে স্মৃতির বাড়িতেও কয়েকবার যান। স্মৃতিকে তিনি 'বোন' পরিচয় দিতেন। স্মৃতির মাকে ডাকতেন 'মা'। দুর্ঘটনার দু'দিন পর তিন বন্ধু ও গাড়িচালক শহীদ ঢাকা চলে যান। স্মৃতি নিখোঁজ রহস্যের জট না খুলতেই পুলিশ কেন তাদের ছেড়ে দিল তা নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

No comments:

Post a Comment