Thursday, May 19, 2011

যশোর জেলা আইনজীবী সমিতি সভাপতির শিকার নারী মক্কেল

আইনের আশ্রয় নিতে এসে এক আইনজীবীর কুনজরে পড়েন এক গৃহবধূ। আর এ অবস্থায় ধরা পড়ে জনতার হাতে গণপিটুনির শিকার হয়েছেন ওই আইনজীবী। ঘটনাটি ঘটেছে রোববার রাতে যশোর শহরের মৎস্য ভবনের রেস্ট হাউজে। ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়ায় গোটা শহরে শুরু হয়েছে আলোচনার ঝড়। গতকাল দিনভর মুখরোচক আলোচনা ছিল শহরের চায়ের দোকান থেকে রাজনীতির টেবিলে। যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি ইমদাদুল হক শেখ বলেছেন, ঘটনা সবই সত্য। কিন্তু একজন সম্মানিত লোক হওয়ায় ওই আইনজীবীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তবে এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতি কি ব্যবস্থা নেয় তা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। এছাড়া ঘটনা তদন্ত হচ্ছে।
এডভোকেট শরীফ আবদুর রাকিব। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বর্তমানে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি। তিনি একটি মানবাধিকার সংগঠনের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ভাল আইনজীবী হিসেবে শহরে রাকিবের আলাদা সুনাম আছে। এ কারণে তিনি বার বার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ভাল আইনজীবী হওয়ার সুবাদে তার মক্কেলও বেশি। তারই ধারাবাহিকতায় শনিবার রাতে এক নারী মক্কেলকে কৌশলে রাকিব নিয়ে যান শহরের বাইরে জেলা মৎস্য ভবনের রেস্ট হাউজের দোতলার একটি রুমে। সঙ্গে ছিল দেশী মদ ও গরুর পোড়া মাংস। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শরীফ রাকিব রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন।
সেখানে জোর করে ওই গৃহবধূকে মদ পান করিয়ে মাতাল করে তোলেন। ঘরের ভেতর যখন শরীফ রাকিব গৃহবধূর সঙ্গে ব্যস্ত তখন বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছিল রেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার ফজর আলী। ঘটনা চক্রে খবর পৌঁছে যায় স্থানীয় একদল যুবকের কাছে। তারা রাত সাড়ে ৮টার দিকে রেস্ট হাউজের দোতলার ওই কক্ষটি ঘিরে ফেলে। গোপনে তারা মোবাইল ফোনে ভিডিও করে শরীফ আবদুর রাকিব ও মেয়েটির নগ্ন দৃশ্য। তোলা হয় স্টিল ছবিও। একপর্যায়ে তরুণরা ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে তাদের দু’জনকে বিবস্ত্র অবস্থায় আটক করে। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে কান্না কাটি শুরু করে শরীফ রাকিব। রাকিব যুবকদের মোটা অঙ্কের টাকাও অফার করেন ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য। ততক্ষণে খবর পৌঁছে যায় শহরে। খবর পেয়ে সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যান ঘটনাস্থলে। শুরু হয় ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক। বয়সের ব্যবধান ভুলে শরীফ রাকিব সকলের হাত পা ধরেন ছবি না তোলার জন্য। তারা শরীফ রাকিব ও মেয়েটির যুগল ছবি ক্যামেরাবন্দি করেন। এরই মধ্যে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি আর কিল ঘুষি। স্থানীয় যুবকরা শরীফ রাকিব ও গৃহবধূকে বেদম মারপিট করে। তাদের বাধা দিতে গিয়ে মারধরের শিকার হয় স্থানীয় অপর এক যুবক। এই ভাবে চলতে থাকে রাত প্রায় ১০টা পর্যন্ত। এরই মধ্যে খবর পৌঁছে যায় যশোর কোতোয়ালি থানায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমদাদুল হক শেখ সঙ্গীয় ফোর্সসহ রেস্ট হাউজে যান রাত সাড়ে ১০টার দিকে। তিনি যুবকদের কবল থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় শরীফ রাকিব ও তার মেয়েটিকে উদ্ধার করেন। পরে দু’জনকে দুটি মাইক্রোবাসে চড়িয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন ওসি ইমদাদ। এই প্রসঙ্গে ওসি বলেন, রাকিব সাহেব যেহেতু জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও মানবাধিকার সংগঠক, তাছাড়া এ ব্যাপারে যেহেতু থানায় কেউ কোন অভিযোগ করেনি তাই রাকিব সাহেবকে ঘোপের বাসায় নামিয়ে দিয়েছি। আর মেয়েটি প্রসঙ্গে তিনি বলেন মেয়েটি নিরাপত্তা হেফাজতে আছে।
এদিকে ঘটনার শিকার গৃহবধূ সম্পর্কে পাওয়া গেছে লোমহর্ষক তথ্য। ঢাকার গাজীপুর এলাকার এ গৃহবধূর স্বামী যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রয়েছে। একটি চোরাচালান সংক্রান্ত মামলায় সে জেল খাটছে। স্বামীকে কারামুক্ত করতে এক মাস আগে যশোর আসে গৃহবধূ। জেলা আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে পরিচয় হয় সমিতির সভাপতি শরীফ রাকিবের সঙ্গে। তিনি তার এক জুনিয়র আইনজীবীর মাধ্যমে মামলাটি আদালতে তোলেন। তিনি তার স্বামীকে জামিন করিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেবেন এই আশ্বাস দেন। রোববার তার স্বামীর জামিনের শুনানির দিন ছিল। সেই জন্য গৃহবধূ রোববার সকাল থেকে শরীফ রাকিবের চেম্বারে অপেক্ষা করতে থাকে। বিকালে রাকিবের জুনিয়র গৃহবধূকে জানায়, ‘আজ আর জামিন হবে না, কাল সোমবার জামিন হবে।’ এ কথা শুনে মেয়েটি বাড়ি চলে যেতে চাইলে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একটি রাত যশোরে থাকার জন্য বলা হয়। এ জন্য শহরের একটি আবাসিক হোটেলে থাকারও ব্যবস্থা করেন ওই জুনিয়র আইনজীবী। এরপর সন্ধ্যার দিকে শরীফ রাকিব ওই জুনিয়রের মাধ্যমে তার চেম্বারে ডেকে নেন এবং মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে শলাপরামর্শ করার কথা বলে তার সঙ্গে যেতে বলেন। গৃহবধূ সরল বিশ্বাসে শরীফ রাকিবের সঙ্গে তার কালো জিপে চড়ে বসেন। তারপর কৌশলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত জেলা মৎস্য ভবনের রেস্ট হাউজে। তার পরই ঘটে এই ঘটনা। এই ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে এডভোকেট শরীফ আবদুর রাকিব বলেন, এই ঘটনা একটি সাজানো নাটক। তাকে চক্রান্ত করে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামীতে দলের জেলা সম্মেলন। এই সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে চান। এছাড়া জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করা হবে। এ ব্যাপারেও তার প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি রয়েছে। এ সব ব্যাপারে তিনি যাতে সামনে আসতে না পারেন, রাজনীতি করতে না পারেন তার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার তার লোকজনকে নিয়ে এই নাটক সাজিয়েছে।
দুই কন্যা সন্তানের জনক রাকিব ছাত্রজীবনে গোপালগঞ্জ থেকে যশোর চলে আসেন। লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করেন ছাত্র রাজনীতি। ছাত্রলীগের রাজনীতি শেষ করে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন। ’৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে রাকিব পত্নী আলেয়া আফরোজ মহিলা কোটায় এমপি নির্বাচিত হয়ে আলোচিত-সমালোচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে রাকিব দলীয় প্রার্থী আলী রেজা রাজুর বিরোধিতা করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী কাজী শাহেদ আহমেদের চশমা মার্কার পক্ষে নির্বাচন করেন। দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও তিনি রাজু’র পক্ষে নির্বাচন না করায় দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। শুরু হয় রাকিবের রাজনৈতিক পতন। যশোর পৌর নির্বাচনেও তার ভরাডুবি ঘটে। পরবর্তীকালে দলের জেলা সম্মেলনেও তিনি পরাজিত হন। একপর্যায়ে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে তাকে দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। দলের একাধিক নেতা মনে করেন, রাকিবের এই অধঃপতনের জন্য তার চারিত্রিক দুর্বলতা অনেকটা দায়ী।
এদিকে রেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার ফজল আলী জানিয়েছেন, রাকিব স্যার গত মাসের ২১ তারিখেও ওই মহিলাকে নিয়ে রেস্ট হাউসে আসেন। ঘণ্টা দুই অবস্থান করে চলে যান। যাওয়ার সময় তাকে ২শ’ টাকাও দিয়ে যান। ঘটনার দিন তিনিসহ মহিলাটি আসে। দরজা খুলে দিতে বললে আমি দোতলার রুমটি খুলে দিই। তাদের হাতে একটি বোতল ও একটি প্যাকেট ছিল। রাকিব স্যার আমাকে গ্লাস দিতে বলেন। আমি গ্লাস নিয়ে আসি। তিনি আমাকে গ্লাস রেখে চলে যেতে বলেন। আমি বের হলে তিনি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। আমি রেস্ট হাউসের নিচ তলায় কাজে ব্যস্ত ছিলাম। প্রায় এক-দেড় ঘণ্টা পরে হৈচৈ শুনে উপরে উঠে দেখি এ অবস্থা। মহিলাটি কান্নাকাটি করছে। রাকিব সাহেবের বেহাল অবস্থা। টেবিলের পরে তখনও বোতল, একটা গামলা ও দু’টি গ্লাস ছিল। রাকিব সাহেব টলছিলেন। আর যুবকরা রাকিব সাহেব ও মহিলাটিকে মারধর করছিল। এ ব্যাপারে ফজল নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, যে দোষ করেছে সে শাস্তি পেয়েছে। এতে আমার অপরাধ কোথায় ? আমি তো হুকুমের গোলাম।

No comments:

Post a Comment