Thursday, June 18, 2009

গুলিতে বিয়ানীবাজারে ওসি নিহত - পুরুষশূন্য কালাইউড়া গ্রাম

সন্ত্রাসীদের গুলিতে সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ মোনায়েম-উল ইসলাম নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার রাত সাড়ে নয়টায় তিনি সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়েন। তার সঙ্গে বিয়ানীবাজার থানার সাব-ইন্সপেক্টর মুজিবুল ইসলামও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া এক বৃদ্ধসহ কয়েকজন এ ঘটনায় আহত হয়েছেন। ঘটনার পর র্যাব ও পুলিশ রাতভর সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে আটক করেছে। এ ঘটনার পর ঘটনাস্থল সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের কালাইউড়া গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গতকাল সকালে প্রায় এক ঘণ্টা কালাইউরা গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়েও কোন পুরুষ পাওয়া যায়নি। এদিকে গতকাল দুপুরে আইজিপি নূর মুহাম্মদ নিহত ওসি মোনায়েম-উল ইসলামের প্রথম জানাজায় অংশ গ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আমরা চিনত্দিত। তিনি বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করা হবে। প্রচলিত আইনে শাসত্দির ব্যবস্থা করা হবে। দুপুর একটায় সিলেটের পুলিশ লাইন মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে আইজিপি নূর মুহাম্মদ, র্যাবের মহাপরিচালক হাসান মাহমুদ খন্দকার ও সিলেটের মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান সহ প্রশাসনের ঊধর্্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। জানাজার নামাজ শেষে নিহত ওসির লাশ তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামার পরানখালি গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। গতকাল বিয়ানীবাজার পৌর শহরে ঢোকামাত্র চোখে পড়ে থানা কম্পাউন্ড। থানা কম্পাউন্ডের ভেতরে এলোমেলো ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন অর্ধশতাধিক পুলিশ কনস্টেবল। তারা সবাই নিশ্চুপ। কেউ কারও সঙ্গে কখা বলছেন না। বাইরে বারান্দায় ডিউটিতে থাকা কনস্টেবলকে লাশ কোথায় জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে ওঠেন। বলেন, হাসপাতালে ভাই। একটি ছোটখাটো টিলার ওপর স্থাপিত বিয়ানীবাজার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। ওখানেও উপস্থিত ৩০-৩৫ জন পুলিশ কর্মকর্তা। সবার চোখে পানি। পাশে একটি খাটের ওপর রাখা ওসি সৈয়দ মোনায়েম-উল ইসলামের লাশ। সাংবাদিকদের দেখামাত্র একজন কনস্টেবল চোখ মুছে লাশের মুখ বের করে দেন। সাংবাদিকরা ছবি তুলছিলেন আর লাশের পাশে কনস্টেবলরা চোখ মুখছিলেন। বাইরে এসে পাওয়া গেল নিহত ওসি'র দুই আত্মীয়কে। তারাও কাঁদছিলেন। জানালেন, খবর পেয়ে তারা ঢাকা থেকে ছুটে এসেছেন।
সকাল ৭টার দিকে ওসি সৈয়দ মোনায়েম-উল ইসলামের লাশ হাসপতাল থেকে বের করে নিয়ে আসা হয় বাইরে অপেক্ষমাণ এম্বুলেন্সে। যখন তার লাশ বাইরে আনা হচ্ছিন তখন পুলিশের অনেক কর্মকর্তা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। তার লাশ দেখতে এ সময় ভিড় জমান এলাকার নারী-পুরুষ। পরে লাশটি নিয়ে আসা হয় সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গুলিবিদ্ধ এসআই মুজিবুল বলেন, আমি ও স্যার এক সঙ্গে ছিলাম। হঠাৎ আমরা শুনি গুলির শব্দ। এ সময় স্যারকে গোঙাতে শুনি। আর কিছুই আমার মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন দেখি আমি হাসপাতালের বেডে। স্যার মারা গেছেন। এ খবর শুনে আমি নিজেকে অপরাধী মনে করছি। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুজিবুল। সকাল সাড়ে ৭টায় কালাইউড়া গ্রামের রাস্তায় ঢুকতেই সুনসান নীরবতা। কোন মানবজন নেই। একটু সামনে যেতেই দেখা গেল কয়েকজন পুলিশ একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সামনে রাস্তায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। আর তারা পাহারা দিচ্ছেন কেউ যেন রক্তে পা না বসায়। গাড়ি দেখলেই পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে আসেন। করেন তল্লাশি। এমনকি যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে তল্লাশি করেন। এমন সময় একজন কনস্টেবল পাশের বাড়ি দেখিয়ে বলেন, ওই বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। জানা গেল ওই বাড়িটিই হচ্ছে ঘাতক ময়াজের। দোতলা একটি বাড়ির ভেতরে ঢুকে অনেক ডাকাডাকি করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। ময়েজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গ্রামের রাস্তার দিকে হাঁটলে একটু সামনে বাম পাশে দেখা যায় খেলার মাঠ। এক কোনায় একটি ছিমছাম ঘর। ঘরের সামনে সাইনবোর্ডে ঝোলানো রয়েছে 'প্যাসিফিক সোশ্যাল ক্লাব'। ক্লাবের দিকে এগিয়ে যেতে ভেতরের দৃশ্য দেখে অাঁতকে ওঠার মতো অবস্থা। ভেতরের সব আসবাবপত্র তছনছ। আগুনে পুড়ে কয়লা। বোঝা যায় এখানেও কোন না কোন তাণ্ডব হয়েছে। ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু'দিকে তাকালে কোথাও কারও দেখা মেলেনি। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে একটু সামনে যাওয়ামাত্র দু'জন মুসলি্লকে পাওয়া গেল। তারা বলেন, আমরা কিছু জানি না। সকাল সাড়ে ৮টায় খুঁজে পাওয়া যায় গ্রামের প্রবীণ এক মুরবি্বকে। তিনি বলেন, নাম বলবো না, কি বলতে চাও বলো। গত রাতে কি হয়েছিল জিজ্ঞেস করতে বলেন, শুনেছি গুলির শব্দ। মিছিলের সুর এবং মানুষের চিৎকার। আর কিছু জানি না। পরে বিয়ানীবাজারের এক সাংবাদিকের কাছ থেকে 'প্যাসিফিক সোশ্যাল ক্লাব'-এর সাধারণ সম্পাদক ইকবাল আহমদের সেল ফোন নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, ঘটনার পর থেকে তিনি অজ্ঞাত স্থানে রয়েছেন। পুলিশ রাতে গোটা গ্রামে তল্লাশি চালিয়েছে। কয়েকজনকে আটক করেছে। এ কারণে ভয়ে তারা সবাই ঘরছাড়া।
ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি জানান, গ্রামের ময়েজ ও তার লোকজন ৪-৫ দিন আগে তাদের ক্লাব ঘরে আগুন দেয়। এজন্য তিনি থানায় জিডি করেন। এ নিয়ে এলাকায় মৃদু উত্তেজনা চলছিল। মঙ্গলবার রাতে তাদের গ্রামের সাবেক এক সেনা কর্মকর্তা এবং আরও দু'জন লোক মোটরসাইকেলে বিয়ানীবাজার শহর থেকে বাড়িতে আসছিলেন। এমন সময় ময়েজ তার পাজেরো জিপ দিয়ে তাদের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেন। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি শুরু হলে এক পর্যায়ে ওই তিনজনকে বেদম মারধোর করে আমেরিকান প্রবাসী ময়েজ ও তার পক্ষের লোকজন। এ সময় ওই তিনজন দৌড়ে গ্রামের ভেতরে যান এবং ঘটনা খুলে বলেন। এক পর্যায়ে লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে ওসি মোনায়েম-উল ইসলাম ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় এলাকার লোকজন তার কাছে নালিশ করেন। ওসি তাদের কথা শুনে ময়েজ ও তার লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে যেতে চাইলে গ্রামের মানুষ তার পিছু পিছু ছোটে। এমন সময় ওপাশ থেকে গুলি ছোড়া হয়। আর ওই গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ওসি মোনায়েম-উল ইসলাম। এর পর ভয়ে তারা দৌড়ে পালিয়ে যান। বিয়ানীবাজার থানা পুলিশের ইনচার্জ এসআই সাদেক জানিয়েছেন, স্যার (ওসি মোনায়েম-উল ইসলাম) গুরুতর আহত হলে তাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পথেই তিনি মারা যান। আহত হন এসআই মুজিবুল হক। এছাড়া আরও কয়েকজন আহত হন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। মামলার বাদী এসআই শাহাদাত। আসামি অজ্ঞাত বলে তিনি জানান। এ ঘটনায় ৫ জনকে আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন সিলেটের এডিশনাল এসপি সাজিদ মোহাম্মদ। পুলিশ সূত্র জানায়, নিহত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নাম সৈয়দ মোনায়েম-উল ইসলাম। তিনি কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার পরাণখালি গ্রামের শিহাবুল ইসলামের ছেলে। পুলিশের এসপি রুহুল আমিন জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে ঘাতকদের ধরতে অভিযান চলছে। সীমানত্দে রয়েছে পাহারা। এছাড়া বিমানবন্দর সহ বিভিন্ন এলাকায় সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। কেউ যাতে পালিয়ে যেতে না পেরে সেজন্য এ অবস্থা বলে তিনি জানান। এদিকে দুপুর একটায় জানাজার নামাজ শেষে ওসি মোনায়েম-উল ইসলাম এর মরদেহ তার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে আইজিপি ও র্যাবের মহাপরিচালক বিয়ানীবাজারের লাউতা ইউনিয়নের কালাইউড়া গ্রাম পরিদর্শন করেন।

ভেড়ামারায় শোকের মাতম
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার সন্তান সিলেটের বিয়ানীবাজার থানার ওসি সৈয়দ মোনায়েম-উল ইসলাম বাচ্চু সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ায় তার গ্রামের বাড়ি ভেড়ামারায় চলছে শোকের মাতম। মঙ্গলবার রাতেই ভেড়ামারায় পেঁৗছে যায় ওসি মোনায়েম-উলের মৃতু্যর খবর। নিহতের গ্রামেরবাড়ি জুনিয়াদহ ইউনিয়নের পরাণখালীতে ভিড় বাড়তে থাকে। সবাই ছুটে যান মোনায়েম-উলের পরিবারের খোঁজখবর নিতে। সেখানে সৃষ্টি হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। পিতা উপজেলা বিএনপি'র সভাপতি ও জুনিয়াদহ ইউপি চেয়ারম্যান শিহাবুল ইসলাম ও মাতা রাশেদা ইসলাম পুত্র শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। নিহতের পারিবারিক সূত্র জানায়, ওসি মোনায়েম-উল ইসলাম বাচ্চু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স কোর্স শেষ করে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে সাব ইন্সপেক্টর পদে যোগ দেন। চাকরি জীবনে অত্যন্ত সততা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে প্রায় এক যুগ পর ইন্সপেক্টর (ওসি) হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর চরমপন্থি অধু্যষিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় সুনামের সহিত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জাতিসংঘ মিশন থেকে ফিরে গত বছর ডিসেম্বরে সিলেটের বিয়ানীবাজার থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন। গতকাল মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্যাসিফিক সোসাইটি অব কালাইউড়া ক্লাবের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক সংঘর্ষে তিনি সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ব্যক্তি জীবনে ওসি মোনায়েম-উলের স্ত্রী সুলতানা খাতুন, কন্যা বর্ণ (১১), পুত্র অর্থ (৪), পিতা শিহাবুল ইসলাম, মাতা রাশেদা ইসলাম ও দুই ভাই ছিল। আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় পরাণখালী হাইস্কুল মাঠে মরহুমের জানাজা নামাজ শেষে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হবে।

No comments:

Post a Comment