Saturday, December 24, 2011

৬ মাসেও খোঁজ মেলেনি ব্যবসায়ী তপন দাসের


সিরাজুল ইসলাম: ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ধরে নেয়ার ৬ মাসেও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি শ্যামপুরের নবীনচন্দ্র গোস্বামী রোডের ব্যবসায়ী তপন দাসের। পরিবারের সদস্যদের দাবি- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অপহরণ করেছে তপনকে। ঘটনাটি অন্যদিকে প্রবাহিত করতে পুলিশ কেবল জানতে চাচ্ছে জমিজমা নিয়ে কারও সঙ্গে তপনের বিরোধ ছিল কি-না। তপন দাসের স্ত্রী সুমি দাস জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত কোন বিরোধ কারও সঙ্গেই ছিল না। ২০শে মে ডিসেম্বর তার বাসায় গিয়ে দেখা যায় ৩০ বছর বয়স্ক গৃহবধূ সুমি দাস স্বামীর স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। ৩ শিশু জিতু (১০), সেতু (৯) এবং কার্তিক (২) অপেক্ষা করছেন- কখন তাদের বাবা বাসায় ফিরবেন। গত ক’দিন ধরেই জ্বরে কাতরাচ্ছে জিতু। তার নানি মাথায় পানি ঢালছেন। জিতু কেবলই তার বাবাকে ডাকছে। ২ বছরের কার্তিকও খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবাকে। মা ও নানি তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন- বাবা চলে আসবে তোমাদের জন্য চকলেট নিয়ে। আনবে শীতের কাপড়। আরও অনেক কিছু।
সুমি দাস জানায়, সাড়ে ৫ মাস ধরে আমার স্বামীকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। ৩রা আগস্ট রাত সাড়ে ৮টায় তাকে গ্রেপ্তার করে মিণ্টো রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি পুলিশ এ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করছে না। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সয়ম তিনি চোখের পানি সংবরণ করতে পারছিলেন না। আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে জানান, পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল প্রাণপ্রিয় স্বামী। ৩ ছেলেকে নিয়ে কিভাবে সাংসার চালাব? তাদের মানুষ করবে কে? এসব ভেবে যখন কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না তখন ২ ভাই এসে হাল ধরছেন আমার সংসারে। ছোটভাই রঞ্জন মোটর পার্টস ব্যবসা ও সুজন স্বর্ণের দোকানে কাজ করে আমার সংসারে টাকা-পয়সা দিচ্ছে। তারা কতদিন দিতে পারবে এটাই প্রশ্ন? এ পরিস্থিতিতে আমি কেবল একটি খবরের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছি। কখন আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত খবরটি- তোমার স্বামীকে ‘অমুক’ জায়গায় পাওয়া গেছে। যেখান থেকেই খবর আসুক না কেন আমি মুহূর্তের মধ্যে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে তাকে ঘরে নিয়ে আসবো। আমার অপেক্ষা আর শেষ হচ্ছে না। টেলিভিশনে একের পর এক গুম ও লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি। তারপরও যেখানে লাশ উদ্ধারের খবর পাচ্ছি সেখানে ছুটে যাচ্ছি।
সুমি জানায়, তপন এবং গোবিন্দ্র একটি রিকশা দিয়ে তাঁতিবাজার মন্দিরের সামনে থেকে রিকশা নিয়ে বাসায় আসছিল। তার সঙ্গে ছিল একই এলাকার বাসিন্দা গোবিন্দ। রিকশায় উঠেই সন্তানদের খোঁজ নিয়েছিল- তারা খাবার খেয়েছে কি-না? রিকশাটি ছাতা মসজিদের সামনে আসতেই একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস এসে রিকশার গতিরোধ করে। একজন নিজেকে ডিবির কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জানতে চায় তার নাম তপন কি-না। তপন হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর থেকেই তার মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। গাড়িতে তুলে কেড়ে নেয়া হয় তার মোবাইল ফোন। কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলা হয় চোখ। পরানো হয় হ্যান্ডকাফ। পরে কালো গ্লাসের গাড়ি থেকে আর একজন নেমে এসে রিকশায় থাকা গোবিন্দের মোবাইল ফোনটিও নিয়ে যায়। পরে তাকেও উঠানো হয় গাড়িতে। তাদের রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরিয়ে ডিবি অফিসের সামনে নিয়ে গোবিন্দকে নামিয়ে দেয়া হয়। তাকে বলা হয় সোজা চলে যা। পেছনের দিকে তাকাবি না। তপনকে নিয়ে গাড়িটি ডিবি অফিসে ঢুকে যায়। তারা গোবিন্দের মোবাইল ফোনটি ফেরত দেয়নি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে গোবিন্দ বিষয়টি আমাকে জানায়। এরপর ডিবি অফিসে গেলে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আস্বীকার করা হয়। পরদিন শ্যামপুর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ জিডি নেয়। জিডি নম্বর ১৯২। সুমি জানান, আমার স্বামীর নামে থানায় কোন মামলা বা জিডি নেই। সে একজন জমি ব্যবসায়ী। কারও সঙ্গে কোন বিরোধ নেই। তপন যদি কোন অন্যায় করে থাকে তাহলে আমি ক্ষমা চাই। তারপর যেন আমার তিন সন্তানকে এতিম করা না হয়। আমাকে বিধবা বানানো না হয়। তিনি বলেন, তপনের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর উচিত ছিল এটা দেখার পর নিরপরাধ মানুষটিকে ছেড়ে দেয়া। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন- আমরা কোন দেশে আছি? তিনি বলেন, যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্রের কোন মূল্যায়ন নেই সেখানে এটা দিয়ে কি করব। আর কখনও ভোট দেব না। ছেলেদেরও বলে দেব তারাও বড় হয়ে যেন ভেটা না দেয়। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী যদি আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে না যেত তাহলে তাকে ডিবি অফিসের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো কেন? সন্ত্রাসীরা কি নিরপরাধ মানুষকে ধরে এত দূর থেকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাবে? তিনি বলেন- আমি জানি আসল ঘটনা কি? তারপরও সাহস করে আসল সত্য সরাসরি বলতে পারছি না। কারণ, স্বামীকে হারানোর পর নিজ, ৩ সন্তান এবং ২ ভাইয়ের নিরাপত্তার কথা ভাবছি। এদের হারাতে চাই না। চাই না তাদের জীবন হুমকির মধ্যে ফেলতে। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন- আপনি যে আমার বাসা থেকে নিরাপদে অফিসে পৌঁছতে পারবেন এর কি নিশ্চয়তা আছে? সুমির সঙ্গে কথা বলার সময় তার সঙ্গে ছিল ভাই রঞ্জন। তিনি জানান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এ ঘটনা ঘটেনি। আমরা সরাসরি মুখ খুললে তারা আমাদেরও নিয়ে যেতে পারে। সুমি জানান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে অভিশাপ দেয়া ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই। যারা আমার ছেলেদের পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করছে, স্বামীর সোহাগ থেকে আমাকে বঞ্চিত করছে তাদের ওপর আমাদের অভিশাপ রইল। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দীর্ঘদিন নীরব ছিল। হঠাৎ করে তারা আমাকে মামলা করার জন্য চাপ দেয়। অবশেষে তাদেরই পরামর্শে অজ্ঞাতদের আসামিকে করে গত ১১ই ডিসেম্বর গেণ্ডারিয়া থানায় মামলা করেছি। এসআই আবুল কালামকে এর তদন্তভার দেয়া হয়েছে। তপনকে অপহরণের পর ৩ দফায় তার মোবাইল ফোন খোলা পেয়েছি। সর্বশেষ ২২শে নভেম্বর তার মোবাইল ফোনটি চালু ছিল। পুলিশকে জানানোর পর কললিস্টের সূত্র ধরে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এমনকি আমার স্বামী উদ্ধার করতে পারছে না। পুলিশ কেবল বলছে- অনেক দেরি হয়ে গেছে।
গেণ্ডারিয়া থানার ওসি ফারুক আহমেদ বিপিএম মানবজমিনকে জানান, আমরা তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি- জমি ব্যবসার বিরোধের জের ধরেই এ ঘটনা ঘটেছে। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তারা তপনের সঙ্গেই ব্যবসা করতো। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম বলা যাচ্ছে না। তিনি জানান, স্বামীকে হারানোর পর সুমিকে খুব একটা চিন্তিত মনে হচ্ছে না। অধিক শোকেও এটা হতে পারে। তিনি বলেন, ঘটনাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করতেই ক্রিমিনালরা গাড়িটি ডিবি অফিসের সামনে নিয়ে গিয়েছিল। ডিবি অফিসের সামনে গোবিন্দকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি পল্টনের দিকে চলে যায়। পুরো বিষয়টি নিয়েই আমরা তদন্ত করছি। আশা করছি শিগগিরই আসল ঘটনা আপনাদের জানাতে পারবো।

No comments:

Post a Comment