Tuesday, November 22, 2011

অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে রহস্যময়ী নারী ও শিশু উদ্ধার

তিন মাস ধরে ফ্ল্যাট ভাড়া দিচ্ছেন না আজমেরী সুপ্তি জেসি চাইতে গেলে বরং বাড়িওয়ালাকে গালমন্দ করছেন এ অবস্থায় সুপ্তিকে ফ্ল্যাট থেকে নামিয়ে দিতে বাড়িওয়ালা নাছিমা হক রমনা থানা পুলিশের সহযোগিতা চেয়েছেন সুপ্তির রহস্যময় জীবনযাপন ও অসংলগ্ন কথাবার্তায় পুলিশও সমস্যায় পড়েছিল পরে মানসিক রোগী বিবেচনায় সুপ্তিকে এক বছরের শিশুসন্তানসহ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নেওয়া হয়
বাড়ির মালিক নাছিমা হক জানান, ৭২ নম্বর সেগুনবাগিচার নাভানা ডাইপেনসিয়ার সি/৫-এ ফ্ল্যাটটির মালিক তিনি। দুই বছর আগে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন আশরাফ ভুট্টো ও তার স্ত্রী সুপ্তি। এ দম্পতি নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়েছিলেন। এখানে থাকা অবস্থায় এক বছর আগে তাদের একটি ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। তিন মাস ধরে তারা ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেন। ভাড়া চাইতে গেলে দুর্ব্যবহার করতেন সুপ্তি। আশরাফকে দীর্ঘদিন পাওয়া যাচ্ছে না। নাছিমা হককে সুপ্তি জানিয়েছিলেন, তিনি আমেরিকার নাগরিক। আশরাফের সঙ্গে প্রেম করে মা-বাবাকে ছেড়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি আরও জানান, এক মাস ধরে সুপ্তি ঘর থেকে বের হতেন না। দরজা-জানালা আটকে সন্তানকে নিয়ে অন্ধকার ঘরে বসে থাকতেন। কেউ দরজার কড়া নাড়লে তার দিকে তেড়ে যেতেন। প্রতিবেশীরা মাঝে মধ্যে তাকে খাবার দিতেন। একপর্যায়ে সুপ্তির ভাসুর ধানমণ্ডির বাসিন্দা আরশাদকে খবর দেওয়া হয়। তিনি সুপ্তিকে বাসা থেকে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলেন।
গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, ফ্ল্যাটে তিনটি বাথরুম থাকলেও তা কখনও ব্যবহার করেনি ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা। মল-মূত্র ত্যাগ করেছে বেডরুমে ও বারান্দায়। ওয়ারর্ড্রোফের কাপড়-চোপড় রাখা হয়েছে ডিপ ফ্রিজে। ফ্ল্যাটের টেলিফোন ও বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন। কখনও খোলা হয়নি জানালা ও দরজা। ফ্ল্যাটের যে অংশ দিয়ে আলো ও বাতাস প্রবেশ করার সম্ভাবনা ছিল তাও কাগজ ও ছেঁড়া কাপড় দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এমন ভুতুড়ে ও বন্য পরিবেশে বাস করছিল সুন্দরী এক গৃহবধূ ও ফুটফুটে এক বাচ্চা। রোববার বিকালে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের যৌথ টিম অভিযান পরিচালনা করে তাদের উদ্ধার করেছে। বর্তমানে তাদের তেজগাঁওয়ের ওমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন সেন্টারের হেফাজতে রাখা হয়েছে। ওমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন সেন্টারের ডিসি শামীমা বেগম বলেন, উদ্ধারকৃত গৃহবধূর নাম আজমেরি সুপ্তি জেসি (৩০)। তার স্বামীর নাম মো. আশরাফ হোসেন ওরফে গুড্ডু। তার কোলে থাকা ফুটফুটে কন্যা শিশুটির বয়স প্রায় এক বছর। সঠিক নাম জানা যায়নি। তিনি বলেন, ৭২ নম্বর বাড়ির ওই ফ্ল্যাটের মালিক রমনা থানায় একটি জিডি করেছিলেন। সেই জিডির সূত্র ধরে রমনা থানা পুলিশ ও ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ওমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করেছে। তিনি আরও বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে উদ্ধারকৃত মহিলাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে হয়েছে। নানা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছেন। জেসি নিজেকে মার্কিন নাগরিক দাবি করেছেন। সরকারের শীর্ষ মহল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক তাদের প্রাণ নাশ হওয়ার অভিযোগ করেছেন। এ কারণেই তিনি কখনও বাইরে বের হন না। দরজা ও জানালা বন্ধ করে রাখেন। সূর্যের আলো ছাড়াও যে কোন ধরনের আলোক রশ্মি তার জীবনের জন্য ভয়ঙ্কর। এর আগে এক ধরনের আলোক রশ্মি দিয়ে তার তিন সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন। ফ্ল্যাটের মালিক নাসিমা হক বলেন, প্রায় দু’বছর আগে আশরাফ হোসেন ওরফে গুড্ডু নামে এক ব্যবসায়ী তার ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। মাসে ২২ হাজার টাকা ভাড়া দিতেন। এডভান্সও দিয়েছিলেন। প্রথমদিকে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করলেও গত তিন মাস ধরে ভাড়া দেন না। ভাড়া ছাড়াও বিভিন্ন বিল বাবদ তাদের কাছে প্রায় লক্ষাধিক টাকা পাওনা রয়েছে। এ অবস্থায় গত প্রায় এক মাস আগে জেসির স্বামী আশরাফ পালিয়ে যায়। তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। আশরাফের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গেলেও তিনি দরজা খোলেন না। সমপ্রতি বাড়ি মেরামতের জন্য কয়েকজন মিস্ত্রি ওই বাসায় প্রবেশ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বমি করতে করতে বাসা থেকে দৌড়ে বের হয়। ফ্ল্যাটের ভুতুড়ে অবস্থা জানালে রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করি। ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রেবেকা সুলতানা বলেন, ফ্ল্যাটটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। উদ্ধারকৃত মহিলা ও শিশুটির সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়নি। রমনা থানা সূত্রে জানা গেছে, জেসির স্বামী আশরাফ ধনীর দুলাল। পুরান ঢাকার ৪/১, আবুল হাসনাত রোডে প্রায় কয়েক কোটি টাকার ভূ-সম্পত্তি রয়েছে। পরিবারের চাপে ওই স্ত্রীকে পরিত্যাগ করার জন্য তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে যান। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ চলছিল। সেই কলহের সূত্র ধরেই জেসি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে থাকতে পারেন। প্রতিবেশীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে তারা উপোস ছিল। বাসায় কোন খাবার ও অর্থকড়ি ছিল না। রাত হলেই তাদের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যেত। প্রকৃত অভিভাবক পাওয়া গেলে তাদের কাছে মা ও শিশুকে হস্তান্তর করা হবে। রমনা থানার ওসি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে উদ্ধার হওয়া মহিলা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক।
গতকাল সোমবার সুপ্তির আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছেন একাধিক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ। তাদের কাছে সুপ্তি শুধু ভয় আর শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। পিতৃপরিচয় জানতে চাইলে তিনি বারবার উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। সুপ্তির ধারণা, তাকে যারা সাহায্য করতে আসবেন তাদের সাবাইকে মেরে ফেলা হবে। তিনি বারবার বলছেন, 'আমার স্বামীকে ওরা অপহরণ করে আটকে রেখেছে। আমার ব্যবসা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও পাসপোর্টও ওরা লুট করেছে।'
ঢাকা আহছানিয়া মিশনের মনোরোগ চিকিৎসক ডা. রাহেনা বেগম সমকালকে বলেন, সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও সুপ্তির পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। যে কোনো কঠিন মানসিক আঘাত বা নির্যাতনের কারণে তার এ অবস্থা হতে পারে।

No comments:

Post a Comment