Tuesday, June 1, 2010

নিভে গেল আলেয়ার জীবন আলো

অবশেষে নিভে গেল আলেয়ার আলো। গতকাল রাত সোয়া ১১টায় সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যায়। মাত্র ১৮ বছরের জীবন। এই ছোট্ট জীবনে অপূর্ণ থেকেছে অনেক চাওয়া-পাওয়ার। অর্থ-কষ্টের সংসারে সারা দিনই ছিল খাওয়া-পরার চিন্তা। এর মধ্যেও ছিল ক্যান্সার আক্রান্ত মাকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা। ছিল ছোট্ট দুটি ভাইয়ের ভরণ-পোষণের ভাবনা। আবার বাবাকে কাছে না পাওয়ার বেদনা। আলেয়াদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাসন গ্রামে। মায়ের অসুস্থতার পর তার বাবা রিকশা মিস্ত্রি রশিদ দ্বিতীয় বিয়ে করে গাজীপুরে থাকেন। এমন পরিস্থিতে গোটা পরিবারের দায়িত্ব পড়ে তরুণী আলেয়ার কাঁধে। কিন্তু তাতে দমে যায়নি সে। সংসারের হাল ধরতে চাকরি নেয় একটি গার্মেন্টে। এই ছোট্ট বয়সে নিজেকেসহ চারটি মুখের অন্ন জোগাতে অদম্য সাহসের সঙ্গেই পথে নামে কিশোরী আলেয়া। কিন্তু হায়, তার অপরাধ সে দেখতে সুন্দরী। আর জন্মগ্রহণ করেছে গরিবের সংসারে। গরিবের সংসারে সুন্দরী হয়ে জন্মানোটাও পাপ।

গার্মেন্টে যাওয়ার পথে তার ওপর চোখ পড়ে বখাটে খোকনের। এরপর নিয়মিত তাকে উত্ত্যক্ত করত খোকন ও তার সহযোগীরা। এক পর্যায়ে আলেয়ার পরিবারের কাছে বিয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়। আলেয়ার পরিবার খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, খোকন বিবাহিত। এমনকি তার এক সন্তানও রয়েছে। এছাড়া খোকনের নেই কোনো বৈধ অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থাও। মাদক বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত সে। এসব তথ্য জানার পর আলেয়ার পরিবার খোকনকে সাফ জানিয়ে দেয়, আলেয়ার সঙ্গে তার বিয়ে সম্ভব নয়। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় গত বুধবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর পল্লবীর ৬ নম্বর সেকশনের ৩৮ নম্বর বাসা থেকে ১১ নম্বর বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলেই খোকন তার তিন সহযোগী বিল্লাল, রনি ও বাবুকে নিয়ে আলেয়ার শরীরে পেট্রোল ঢেলে দেয়। ওই দিন আলেয়া তার খালা রাজিয়া খাতুনকে নিয়ে বাজারে যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়েছিল। অন্ধকার গলিতে হঠাৎ তাদের রিকশা আগলে দাঁড়ায় আলেয়ার বখাটে প্রেমিক খোকন। এ সময় বাসার পাশে ডেকে নিয়ে খোকন ও তার তিন সহযোগী মিলে আলেয়ার গায়ে পেট্রোল ঢেলে দেয়। ওই রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টানা পাঁচদিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ছিল আলেয়া। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিল সে। মৃত্যুর কাছে হার মেনে গতকাল সোমবার রাত সোয়া ১১টার দিকে চিরকালের জন্য নিভে গেল আলেয়ার আলো।

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ঘটনা : বুধবার রাত সাড়ে ৭টায় পল্লবীর ডি ব্লকের ৬ নম্বর সেকশনের ৩৮ নম্বর বাসা সংলগ্ন সূচনা ব্লক হাউজের সামনেই খোকনসহ তার তিন সহযোগী আলেয়া খাতুনের শরীরে পেট্রোল ছুড়ে দেয়। এ ঘটনার বর্ণনা করে ডি ব্লকের নির্মাণাধীন একটি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী মোঃ আল আমীন সমকালকে জানান, খোকনের সহযোগী বাবু আলেয়ার শরীরে পেট্রোল ঢেলে দেয়। এর পরপরই ম্যাচের কাঠি দিয়ে আগুন লাগায় খোকন। মুহূর্তেই দাউ দাউ করে ৭/৮ হাত ওপরে আগুনের শিখা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় 'বাঁচাও বাঁচাও' বলে চিৎকার করে ওঠেন আলেয়া। আগুনের তাপে ভয়ে তার কাছে কেউ যেতে পারেনি। সূচনা ব্লক হাউজের কাটিং মাস্টার মোস্তফা জানান, আলেয়ার শরীরে আগুন দেখে মনে হয়েছিল, যেন আগুনের দৈত্য গ্রাস করছিল ফুলের মতো একটি মেয়েকে। এরপর আশপাশের লোকজন দূর থেকে তার শরীরে পানি ছিটিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে বাঁচার জন্য রাস্তার ওপরে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে গড়াগড়ি দিয়ে কোনোমতে প্রাণ বাঁচান আলেয়া। ঘটনার পরপরই খোকনসহ অন্য দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে খোকনকে আটক করে এলাকাবাসী। দেওয়া হয় উত্তম-মধ্যম। এরপর তাকে পল্লবী থানা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আলেয়াদের প্রতিবেশী গৃহিণী তাসলিমা বেগম জানান, দুটি মোটর সাইকেলে খোকনসহ চার যুবক এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বাসার কিছু দূরে মোটরসাইকেল রেখে খোকন মোবাইল ফোনে আলেয়াকে ডেকে আনে। কিছু সময় কথা বলার পর তাদের সঙ্গে থাকা একটি মগের পেট্রোল তার শরীরে ঢেলে দেয়। মোটরসাইকেলের পেট্রোল দিয়েই তাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে।

পুলিশের বক্তব্য : আয়েলাকে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার ঘটনায় পল্লবী থানায় শিশু ও নারী নির্যাতন আইনের ৪/১ ধারায় একটি মামলা হয়েছে। হতভাগী আলেয়ার খালা ময়না বেগম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় খোকন ছাড়া আরও দু'জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। পল্লবী থানার অফিসার ইনচার্জ ইকবাল হোসেন সমকালকে বলেন, গুদারাঘাট এলাকায় থাকার সময় আলেয়ার সঙ্গে খোকনের পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে খোকন তার প্রেমে পড়ে। পরে আলেয়া জানতে পারেন, সে বিবাহিত ও মাদকের সঙ্গে জড়িত। এ খবর জানার পরপরই আলেয়া তাকে এড়িয়ে চলেন। এই ক্ষোভ থেকেই সে নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, খোকন নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এর আগে মিরপুর থানা পুলিশের কাছে সে ফেনসিডিলসহ ধরা পড়ে। এছাড়া ছিনতাই করতে গিয়ে গুলশান থানা পুলিশের হাতেও সে ধরা পড়েছিল। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খোকনকে দু'দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পল্লবী থানা পুলিশ।

তার অকাল মৃত্যুতে গতকাল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণা হয়। মেয়ের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরপরই আইসিইউতে বিলাপ করছিলেন তার মা হাছনা বেগম ও বাবা আবদুর রশিদ। তারা বিলাপ করছিলেন আর বলছিলেন, 'ওরা আমার মেয়েকে বাঁচতে দিল না।' অসুস্থ শরীর নিয়ে মেয়েকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ায় গতকাল সকালেও মাকে বকাবকি করে আলেয়া। এসব কথা বলে ক্যান্সার আক্রান্ত মা বলছেন, 'আমার মৃত্যুর আগেই ওর লাশ দেখে যেতে হলো।'

No comments:

Post a Comment