Thursday, August 5, 2010

মায়ের পরকীয়ায় শিশুকন্যার গলিত লাশ সানশেডে - জানালা দিয়ে ফেলতে জেনিফার মাথার দু'পাশে কাটা হয়

মোহাম্মদপুরে সামিউল হত্যাকাণ্ডের পর এবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে মায়ের পরকীয়ায় নৃশংসতার শিকার হয়েছে এক শিশুকন্যা। সাড়ে তিন বছর বয়সী হতভাগা ওই শিশুকন্যার নাম জেনিফার ইসলাম তানহা। গতকাল দুপুরে খিলগাঁও থানাধীন সিপাহীবাগ এলাকার একটি উঁচু ভবনের পঞ্চম তলার জানালার সানশেডের উপর থেকে শিশুটির অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ তানহার গর্ভধারিণী মা হালিমা বেগম ওরফে তমাকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশ জানায়, হালিমাকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তার যোগসাজশেই প্রেমিক রেজাউল করিম শিশু তানহাকে হত্যা করতে পারে। তবে ঘটনার পর থেকে রেজাউল পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, গতকাল দুপুর থেকে খিলগাঁও থানার সিপাহীবাগ এলাকার মদন গলির ২৬৯ নম্বর বাসা থেকে লাশের উৎকট গন্ধ বের হচ্ছিল। তখন ওই ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে মৃত মানুষের গন্ধ বলে সন্দেহ হয়। তখন অনেকে খোঁজাখুঁজিও করে। তবে পঞ্চম তলার তালাবদ্ধ ফ্ল্যাট থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে এমন অনুমাননির্ভর হয়ে লোকজন পুলিশকে বিষয়টি জানায়। দুপুর আড়াইটার দিকে ওই ভবনের পঞ্চম তলার ভাড়াটিয়া রেজাউল করিম দম্পতির জানালার সানশেডের উপর থেকে পুলিশ অর্ধগলিত তানহার লাশ উদ্ধার করে। এসআই এবিএম ফারুক আহমেদ জানান, লাশের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পচন ধরেছে। কালচে রক্তমাখা নাক ও কান ঘিরে পিঁপড়া ও মাছি ভনভন করছিল। ফারুক হোসেন বলেন, পাঁচ বছর আগে তমাকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করি। সমপ্রতি স্ত্রী ও শিশুকন্যা তানহাকে নিয়ে রেজাউলের সঙ্গে সাবলেটে ভাড়া থাকতে শুরু করি। সেখান থেকেই তমার সঙ্গে রেজাউলের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। পরে তাকে না জানিয়েই সন্তানকে নিয়ে রেজাউলের সঙ্গে নতুন করে ঘর বাঁধে। বিয়ের খবরও শুনতে পাই। একই এলাকার মদন গলির ওই বাসায় থাকতে শুরু করে। গতকাল ওই বাসা থেকেই পুলিশ শিশুকন্যাটির লাশ উদ্ধার করে। এদিকে গত দুই/তিন ধরে শিশুটির কোন খোঁজ না পেয়ে তার স্বজনরা ঘটনাটি পুলিশকে জানায়।

জানালার গ্রিলে ফাঁক ৬ ইঞ্চি। এ ফাক গলে সাড়ে ৩ বছর বয়সী শিশু তানহা ইসলাম জেনিফার লাশ নিচে ফেলা সহজ ছিলো না। তাই খুন করার পর জেনিফার মাথার দু’পাশে কেটে ও পাঁজরের হাড় ভেঙে ফেলে দেয়া হয়। তবে সানশেডে আটকে যায় লাশ। প্রাথমিক অনুসন্ধানের পর এ কথা বলেছেন খিলগাঁও থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই আসলাম হোসেন। তিনি অবশ্য বলেছেন, জেনিফাকে খুন করে সানশেডে লাশ ফেলা নিয়ে অসংলগ্ন কথা বলছেন মা হালিমা ইয়াসমিন। একবার বলছেন, তাকে শ্বাসরোধ করে মেরেছে রাজীব। আরেকবার বলেছেন, আমি লাশ দেখিনি। কখনও বা বলেছেন, সারাদিন লাশ নিয়ে বসে ছিলাম, রাতে রাজীব এসে লাশ জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, লাশের মাথার দু’পাশে বঁটি দিয়ে কাটা হয়েছে। পাঁজরের হাড় ভেঙে ছোট করা হয়। গ্রিলে মাথার চুল ও রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। সেটি চেনার কোন উপায় ছিল না।

সন্তান খুনের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় হালিমাকে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। বুধবার মধ্যরাতে পলাতক রাজীবের ভাই সজীবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়েছে। রাজীবকে খুঁজছে পুলিশ। ওদিকে ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল সন্ধ্যায় জেনিফার লাশ মিরপুর-১০ নম্বর এলাকার কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২৭শে জুলাই দুপুরে জেনিফাকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুরের স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে হালিমা। সাড়ে সাত ভরি সোনার গহনা, এক লাখ টাকা ও জমির দলিল নিয়ে ওঠে পরকীয়া প্রেমিক রেজাউল করিম ওরফে রাজীবের উত্তর গোড়ানের ভাড়া বাসায়। পরদিন রাতেই জেনিফাকে খুন করা হয়। বলা হচ্ছে- সারাদিন লাশ রাখার পর ২৯শে জুলাই রাতে জানালা দিয়ে ফেলে পালিয়ে যায় রাজীব। ৪ঠা আগস্ট দুপুরে জেনিফার গলিত লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় পুলিশ। ওইদিন শেষে রাতে নিহতের পিতা ফারুক গাজী বাদী হয়ে খিলগাঁও থানায় স্ত্রী হালিমা ও রাজীবকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। জেনিফার পিতা ফারুক গাজী বলেন, আমার মেয়ে কী দোষ করেছিল? তাকে কেন খুন করা হলো? হালিমা-রাজীবের বিয়েতে তো আমার মেয়ে বাধা দেয়নি। মেয়েকে আমার কাছে রেখে গেলে তো হারাতে হতো না। তিনি বলেন, আমার মেয়েকে যে-ই খুন করুক, তাদের ফাঁসি চাই। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেখে যেন আর কোন মায়ের কাছে সন্তান অনিরাপদ না থাকে।

ঘটনাস্থল: রাজধানীর খিলগাঁও থানার উত্তর গোড়ানের সিপাহীবাগ মদনগলির ২৬৯ নম্বর ৫তলা বাড়ির মালিক আবুল বাসার। ৫ম তলার দু’টি ফ্ল্যাট টিনশেড। উত্তরপাশের ফ্ল্যাটে চারটি রুম। বাড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত বশির আহম্মেদ বলেছেন, ২৭শে জুলাই সকালে ১০ হাজার টাকা চুক্তিতে ভাড়া নেয় রাজীব। ৫ হাজার টাকা অগ্রিম দেয়। এরপর দিনই হালিমা ইয়াসমিন ও জেনিফাকে বাসায় নিয়ে আসে।

প্রতিবেশীদের বর্ণনা: তৃতীয় তলার ভাড়াটিয়া বাড়ি মালিকের ভগ্নি জোসনা বিন তেনু বলেন, ২রা আগস্ট ভোরে আমার খালাত ভাই সোহেলের কাছে হালিমা এসে ২০০ টাকা ধার চায়। সে সময় হালিমা অস্বাভাবিক ছিল। সোহেল জানতে চায়, টাকা দিয়ে কি হবে? হালিমা বলেছিল, আমার স্বামী বাসায় নেই। মোবাইলে ফ্লেক্সি করবো। সোহেল টাকা না দিলে চলে যায় হালিমা। বাড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত বশির আহম্মেদ বলেন, মঙ্গলবার পাঁচতলার জানালায় হালিমাকে দেখার পর রাতে তার কাছে ভাড়ার জন্য যাই। হালিমা বলে আমার স্বামী (রাজীব) বাসায় নেই। তিনি এলেই ভাড়া দেয়া হবে। ওই রাতে ১১টার দিকে হালিমা একটি ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির লোকজন তাকে আটকায়। এরপর দিন সকালে ফ্ল্যাটে বৈদ্যুতিক কাজের জন্য গেলে জানালার বাইরে থেকে তীব্র দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। বশির বলেন, আমি গ্রিলে উঁকি মেরে একটি বাচ্চার হাত দেখতে পাই। এর পরই পুলিশকে খবর দেয়া হয়। রং মিস্ত্রী আবদুল জলিল বলেন, এখানে রঙের কাজ করছি। ২৭শে জুলাই দুপুরে হালিমাকে আসতে দেখি। ২রা আগস্ট হালিমার ফ্ল্যাটে রান্না ঘরে রং করতে গিয়ে প্রচণ্ড গন্ধ পাই। এ নিয়ে হালিমাকে প্রশ্ন করলে সে বলে ইঁদুর মরেছে। আমরা দুর্গন্ধের জন্য কাজ না করে চলে আসি।

পুলিশের বক্তব্য: খিলগাঁও থানার অপারেশন অফিসার এসআই আসলাম হোসেন বলেন, তানহা ইসলাম জেনিফাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়েছে মা হালিমা ইয়াসমিন ও তার দ্বিতীয় স্বামী রাজীবই জেনিফাকে হত্যা করেছে। ২৯শে জুলাই রাতে বাসার উত্তর পাশের জানালা দিয়ে লাশ ফেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। জেনিফার দেহ জানালার ফাঁক দিয়ে না ঢোকায় ধারাল বঁটি দিয়ে মাথার পাশে কাটা হয়। দেহ ভেঙে ছোট করে ফেলা হয় জানালা দিয়ে। লাশ উদ্ধারের সময় জানালায় মাথার ছোট চুল লেগে ছিল। একটি ধারাল বঁটিও উদ্ধার করেছে পুলিশ। তাতে মাথার চুল ও রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। হালিমা পুলিশের কাছে বলেছেন, জেনিফাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ওই ফ্ল্যাটে শুধু হালিমাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল রাজীব। সবকিছু নতুন করে সাজাতে চেয়েছিল।

হালিমা ইয়াসমিন যা বললেন: হালিমা ইয়াসমিন খিলগাঁও পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর বলেন, শবেবরাতের পরের দিন ২৮শে জুলাই রাত দু’টার দিকে রাজীব দই খেতে দেয়। রাজীব দইয়ের সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিলে অচেতন হয়ে পড়ি। পরদিন সকালে সংজ্ঞা ফেরার পর দেখি মেয়ে জেনিফা ঘুমিয়ে রয়েছে। মেয়েকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা করি। ঘুম না ভাঙায় সন্দেহ হয়। রাজীবকে বলি, মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। একপর্যায়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে হালিমা বলেন, আমি বুঝতে পারি আমার মেয়ে মারা গেছে। রাজীবকে ফোন দিই। সে আসে সন্ধ্যায়। লাশ কি করবো ভেবে পাইনি। রাতে রাজীব জানালা দিয়ে লাশ ফেলে দেয়। রাজীবই জেনিফাকে খুন করেছে।

ফারুক গাজী যা বললেন: মিরপুর ১১ নম্বর বাজারের মুদি ব্যবসায়ী ফারুক। একই এলাকায় স্ত্রী হালিমা, মেয়ে জেনিফা ও শ্যালক জুয়েলকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। ২৭শে জুলাই সকালে তিনি দোকানে যান। বেলা ১২টার দিকে তার স্ত্রী হালিমা তাকে ফোন দিয়ে জানান, বাসার চাবি জানালায় আছে। ফারুক জানতে চান, হালিমা কোথায় যাচ্ছো? এ সময় হালিমার উত্তর ছিল- জাহান্নামে যাচ্ছি। আর ফিরবো না। ফারুক বলেন, বাসায় ফিরে দেখি ১ লাখ টাকা, জমির দলিল ও সাড়ে সাত ভরি সোনার গহনা নেই। এসব নিয়ে সে পালিয়েছে। ২৮শে জুলাই পল্লবী থানায় একটি জিডি করি। ভাবতেও পারিনি হালিমা রাজীবের সঙ্গে চলে গেছে। আমরা খোঁজাখুঁজি করি তাকে। ৩রা আগস্ট হালিমা ফোন দিয়ে বলে, আমি বিপদে পড়েছি। জেনিফা মারা গেছে। আমি রাজীবকে বিয়ে করেছি। ফারুক বলেন, তখনই জানি রাজীবের কথা। এর আগে কখনও এ সম্পর্কের কথা জানতে পারিনি। দেড় বছর আগে রাজীব ও আমরা একই বাসায় ভাড়ায় থাকতাম। তখন থেকেই হয়তো ওদের সম্পর্ক। তবে কখনও বুঝতে পারিনি। তাছাড়া আমি দিনে বাসায় থাকতাম না। শ্যালক জুয়েল ও আমি দোকানদারি করতাম। রাতে বাসায় ফিরতাম।

No comments:

Post a Comment