Friday, September 24, 2010

পাবনায় অসহায় প্রশাসন বিচার চায়


‘ওরা সেদিন যা করেছিল, তা শুধু সিনেমাতেই ঘটে। প্রকাশ্যে তারা কর্মকর্তাদের ধাওয়া করে লাঞ্ছিত করে। বেল্ট দিয়ে ভাঙচুর করে গাড়ির কাচ। আমরা চাকরি করতে এসেছি, মার খেতে আসিনি।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন পাবনা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত ফারজানা। গতকাল বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে পাবনার সুধীজনদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠকে উপস্থিত বক্তারা সবাই নিজেদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করে এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন। ইশরাত ১৭ সেপ্টেম্বর পাবনা জেলা প্রশাসনে তৃতীয় শ্রেণীর নিয়োগ পরীক্ষার সময় সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে হামলা চালিয়ে পরীক্ষা ভণ্ডুল করে দেন। এ সময় পরীক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত হন।

গতকালের বৈঠকে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিজয় ভূষণ পাল বলেন, ‘আমার ২১ বছরের চাকরিজীবনে এমন নারকীয় ঘটনা দেখিনি। ওরা সেদিন আমাকেও ধাওয়া করে মারধর করে। সরকারের কাজ করতে গিয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত হতে হলে এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে!’

পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শিবজিৎ নাগ বলেন, ‘সেদিন যা ঘটেছে, তা পাবনাবাসীর জন্য লজ্জার। সেদিন জেলা প্রশাসনের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়নি, বাধাগ্রস্ত হয়েছে সরকারের কাজ।’

নিয়োগ পরীক্ষা ভণ্ডুলের ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সুধীজনদের সঙ্গে এই বৈঠকের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক এ এফ এম মনজুর কাদিরের সভাপতিত্বে বেলা ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত বৈঠক চলে। এতে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা, উপজেলা ও পৌরসভা চেয়ারম্যান, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও সাংবাদিকেরা অংশ নেন। বৈঠকের শুরুতে জেলা প্রশাসক মনজুর কাদির হামলার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। পরে তিনি অন্যদের কথা বলতে বললে প্রশাসনের কর্মকর্তারা একে একে ঘটনার বর্ণনা দেন। সরকারি কর্মকর্তারা এ ঘটনাকে ন্যক্কারজনক উল্লেখ করে বলেন, সন্ত্রাসীরা পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যখন এমন আচরণ করে, তখন বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ কী অবস্থায় আছে। এদের শাস্তি না দিলে দেশে এর চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে।বৈঠকে বক্তারা সেদিনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন করেন। পুলিশ সেদিন কেন সন্ত্রাসীদের থামানোর চেষ্টা করল না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে। ঘটনার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও মূল আসামিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাঁরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও পাবনার পুলিশ সুপার গতকালের বৈঠকে যাননি। তবে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোশাররফ হোসেন মিয়াজী। তিনি বলেন, ‘দুটি পরীক্ষাকেন্দ্রে অল্পসংখ্যক পুলিশ ছিল। সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপরও হামলা চালায় এবং আমরা বুঝে ওঠার আগেই তারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।’ তিনি বলেন, পুলিশ আসামিদের ধরতে তৎপর রয়েছে। শহর থেকে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন পরিবহনের বাসে তল্লাশি চালানো হচ্ছে এবং শহরের বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে।

বৈঠকে প্রবীণ সাংবাদিক ও কলামিস্ট রণেশ মৈত্র বলেন, ‘পুলিশ এখন কয়েকজন সন্ত্রাসীর চাকরি করছে। তারা প্রশাসনকেও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। কিন্তু এই প্রশাসন তাদের দায়িত্বে এবং কর্তব্যে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে। তাই পাবনার মানুষ তাদের সঙ্গে আছে।’

জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি ও পাবনা ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম বলেন, ‘প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ধাওয়া দিয়ে ধরে সন্ত্রাসীরা মারবে আর পুলিশ তা দেখে চুপ করে বসে থাকবে, এটা হতে পারে না। প্রশাসনের নিরাপত্তা না থাকলে জনসাধারণের নিরাপত্তা কোথায়? গুটিকয়েক সন্ত্রাসীর জন্য পাবনার মানুষ আজ নিরাপত্তাহীন। আমরা এ অবস্থার পরিত্রাণ চাই।’

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পাবনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, মাত্র সাত-আটজন সন্ত্রাসী এই শহরের সবাইকে জিম্মি করে রেখেছে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি পাবনা জেলা শাখার সভাপতি মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ‘যেখানে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ মার খাচ্ছে, সেখানে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের যদি শাস্তি দেওয়া না হয়, তাহলে সারা দেশ অনিরাপদ হয়ে পড়বে।’

পাবনা চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, কয়েকজন সন্ত্রাসীর কাছে পাবনাবাসী জিম্মি থাকতে পারে না। এদের নির্মূল করতে হবে।জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিব হাসান বলেন, যারা এই সন্ত্রাসীদের মদদ দেয়, তাদের বিরুদ্ধে পাবনাবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ জানাতে হবে।মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল পাবনা জেলা শাখার সভাপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা দেশ ও জনগণের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আমাদের প্রাণের দাবি।’

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মনজুর কাদির বলেন, ‘আমি নিজে কখনো অন্যায় করিনি। কোনো অন্যায়কে সহযোগিতাও করিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে চান, সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। তিনি বিদেশে রয়েছেন। ওনার একান্ত সচিব (পিএস) আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি। তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা অপেক্ষায় আছি।’

বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের পরিচালক গোলাম রব্বানী, ইউনিভার্সাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহানী হোসেন, সাঁথিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন, চাটমোহর পৌরসভার চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, পাবনা পৌরসভার কাউন্সিলর শামসুন্নাহার রেখা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোশারফ হোসেন মিয়াজী।

প্রসঙ্গত, ১৭ সেপ্টেম্বর সকালে জেলা প্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা পরীক্ষাকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর চালান। এ ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান, বর্তমান সভাপতি আহম্মেদ শরীফ, জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক জহির হাসান, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এস এম সজীব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, সদর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি জিয়াউল করিম, সাধারণ সম্পাদক ইমরান শেখসহ ৩১ জনের নামসহ শতাধিক অজ্ঞাতনামা নেতা-কর্মীকে আসামি করে দুটি মামলা করা হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। আসামিদের মধ্যে জেলা যুবলীগের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পাদক তরিকুল ইসলাম, যুবলীগের কর্মী মো. সুজন, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মামুন হায়দার, ছাত্রলীগের কর্মী ডিম জনি ও অজ্ঞাত সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে সরোয়ার হোসেন ও আবদুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

হামলাকারীদের পক্ষে মিছিল: হামলাকারীদের পক্ষে গতকালও পাবনা শহরে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মিছিল করেছেন। গতকাল রাত আটটার দিকে জেলা প্রশাসকের অপসারণের দাবি জানিয়ে শহরে মিছিল বের করা হয়। শহরের আবদুল হামিদ সড়কে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি শহর প্রদক্ষিণ করে। এ সময় কয়েক শ নেতা-কর্মী জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেন। তাঁরা এ ঘটনায় গ্রেপ্তার করা আসামিদের মুক্তির দাবি জানান। এ ছাড়া পরীক্ষাকেন্দ্রে হামলা ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের লাঞ্ছিত করার ঘটনায় ছাত্রলীগের চার কর্মীকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। পাবনা জেলা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আহম্মেদ শরীফকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। বহিষ্কৃত কর্মীরা হলেন শেখ সবুর, মান্না, মোহাম্মদ জামি ও সারোয়ার।

No comments:

Post a Comment